শিক্ষক থেকে হুমকিদাতা: সাংবাদিক নিরাপত্তাহীনতার আঞ্চলিক প্রতিচ্ছবি

ভূমিকা: সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমকে বলা হয় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। এর কাজ হলো সত্য প্রকাশ করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং জনগণের কণ্ঠস্বরকে ক্ষমতার মঞ্চে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা বারবার আঘাতের মুখে পড়ছে। সাম্প্রতিক জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ঘটনা এর এক তীব্র উদাহরণ।
কালাই ময়েন উদ্দিন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এম এ জি নাফসি তালুকদারকে সম্প্রতি ৩৩ শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাত করার অভিযোগে শোকজ করা হয়। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হলে তিনি স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিককে হত্যা ও মিথ্যা মামলার হুমকি দেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষার্থীদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ: ২৬ আগস্ট সকালে বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে— “স্যার প্রতিদিন দেরিতে আসে ক্লাসে।” এমন মন্তব্যে ক্ষিপ্ত হয়ে শিক্ষক নাফসি তালুকদার একসাথে ৩৩ জন শিক্ষার্থীকে বেত্রাঘাত করেন। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে তাকে শোকজ করে।
এর আগে তার বিরুদ্ধে আরও কয়েকটি অভিযোগ তদন্তাধীন ছিল:
-
সরকারি জায়গা দখল করে দলীয় অফিস খোলা
-
সহকর্মী শিক্ষক ও হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্সদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার
-
রাজনৈতিক পরিচয়ের অপব্যবহার
অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের ঘটনা ছিল এক দীর্ঘ অভিযোগপত্রের অংশমাত্র।
সাংবাদিকদের প্রতি ভয়ভীতি ও হুমকি: শিক্ষার্থীদের অভিযোগ সংবাদে প্রকাশ হতেই নাফসি তালুকদার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। স্থানীয় সাংবাদিকদের অভিযোগ:
-
রাব্বিউল হাসান (দৈনিক বাংলার প্রতিনিধি): ফেসবুকে খোলা চিঠি লিখে জানান, তাকে ও তার পরিবারকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কোনো ক্ষতি হলে দায় নিতে হবে নাফসি তালুকদারকে।
-
সাউদ আব্দুল্লাহ (দৈনিক কালের কণ্ঠ প্রতিনিধি): মন্তব্য করেন, “সত্য বলা এখন জীবন-মরণের প্রশ্ন।”
-
মাহফুজ রহমান (নাগরিক টেলিভিশন প্রতিনিধি): ফোনে সরাসরি হুমকি পেয়েছেন বলে জানান।
-
সজিবুল ইসলাম পাভেল (এনটিভি ও দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ প্রতিনিধি): ফোনে সরাসরি ডাকাতি মামলায় ফাঁসানোর হুমকি পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেন।
-
আবু রায়হান (আই নিউজ প্রতিনিধি): ম্যাসেঞ্জারে হুমকি পেয়েছেন বলে জানান।
এছাড়া হুমকির শিকার সাংবাদিকরা হলেন, দৈনিক সমকালের জেলা প্রতিনিধি শাহারুল আলম, স্টার নিউজের জেলা প্রতিনিধি আল মামুন, দৈনিক ভোরের দর্পণের জেলা প্রতিনিধি কাজি তানভিরুল ইসলাম রিগানের সহধর্মিণী মনিরা ইসলাম, দৈনিক যুগান্তরের কালাই উপজেলা প্রতিনিধি এটিএম সেলিম সরোয়ার শিপন ও দৈনিক ভোরের আওয়াজের জেলা প্রতিনিধি জীবন তালুকদার লিটন ।
এছাড়া আরও কয়েকজন সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করে জানিয়েছেন, তারা ভয়ভীতির মধ্যে কাজ করছেন।
ইতোমধ্যে কয়েকজন সাংবাদিক জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করেছেন।
প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া:
-
ইউএনও শামীমা আক্তার জাহান বলেন, আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পেয়েছি, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
-
জেলা পুলিশ সুপার মুহম্মদ আব্দুল ওহাব জানান, সাংবাদিকদের থানায় জিডি করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে জয়পুরহাট প্রেসক্লাবের জ্যেষ্ঠ সদস্যরা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের ইতিহাস নতুন নয়। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও সাংবাদিক সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী:
-
প্রায় প্রতিবছর কয়েকশ সাংবাদিক হামলা, মামলা ও হুমকির শিকার হন।
-
আন্তর্জাতিক সংস্থা Reporters Without Borders (RSF) এর Press Freedom Index 2024 অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১৮০ দেশের মধ্যে ১৬৫তম স্থানে রয়েছে।
-
স্থানীয় পর্যায়ে সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি হুমকি পান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে।
এ বাস্তবতায় জয়পুরহাটের ঘটনাটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং সাংবাদিকতার উপর বাড়তে থাকা চাপের একটি স্পষ্ট প্রতিফলন।
শিক্ষকের ভূমিকা ও নৈতিক সংকট: সমাজে শিক্ষক হচ্ছেন নৈতিকতার প্রতীক। কিন্তু যখন একজন শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করেন এবং সাংবাদিকদের হুমকি দেন, তখন সেটি কেবল ব্যক্তি নাফসি তালুকদারের ব্যর্থতা নয়; বরং সামগ্রিকভাবে সমাজে নৈতিক অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত। শিক্ষকের কাছ থেকে যে দায়িত্বশীলতা ও শিষ্টাচারের প্রত্যাশা থাকে, তা ভেঙে পড়লে শিক্ষার্থী ও সমাজ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উপসংহার: সাংবাদিকদের প্রতি হুমকি কেবল কয়েকজন সংবাদকর্মীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়; এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। সত্য প্রকাশের দায়িত্বকে ভয় দেখিয়ে স্তব্ধ করা হলে সমাজ হারাবে তার নৈতিক ভিত্তি।
এ ঘটনার দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি। একইসাথে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষায়—প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সুশীল সমাজ সবাইকে সম্মিলিতভাবে ভূমিকা রাখতে হবে।
সত্য প্রকাশ কোনো অপরাধ নয়, বরং এটি একটি সমাজকে সুস্থ পথে এগিয়ে নেওয়ার শক্তি। আর সেই শক্তিকে দুর্বল করার যে কোনো চেষ্টা প্রতিহত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
লেখক: (কবি, গীতিকার, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষক)
আপনার মতামত লিখুন