তরুণ প্রজন্মের দিকভ্রান্তি ও প্রতিবাদের ভাষা : এক বাস্তব চিত্র

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, সংগ্রামের অগ্নিঝরা দিনগুলো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ আমাদের গর্বের মূলভিত্তি। স্বাধীনতার পরবর্তী প্রজন্মের কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিলো—তারা দেশ গঠনের গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করবে, নৈতিকতা, শৃঙ্খলা, মানবিকতা আর দেশপ্রেমকে বুকে ধারণ করে একটি প্রগতিশীল সমাজ তৈরি করবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র প্রায়ই হতাশাজনক। আজকের তরুণদের একাংশ, বিশেষত যারা রাজপথে রাজনীতির নামে মিছিল-মিটিং করছে, তারা যেন মূল পথ থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে।
একজন মুক্তিযোদ্ধার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে যখন কোনো কিশোরী গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে— “টিনের চালে কাউয়া, শা+উ+য়া…”—তখন লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিতে হয়। কারণ প্রতিবাদের ভাষা এতো অশ্লীল, এতো কুরুচিপূর্ণ হতে পারে—এটা কি আমাদের জাতির জন্য মানানসই? প্রতিবাদ থাকবে, প্রতিরোধ থাকবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠবে—এটাই গণতান্ত্রিক সমাজের সৌন্দর্য। কিন্তু যখন সেই প্রতিবাদ রূপ নেয় কদর্যতায়, তখন সেটি কেবল প্রতিপক্ষকে বিদ্ধ করে না, বরং গোটা জাতির চরিত্রকেই ছোট করে দেয়।
প্রতিবাদের ভাষার অবক্ষয়
বাংলাদেশে প্রতিবাদের ইতিহাস নতুন নয়। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে শুরু করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আন্দোলন—সব জায়গায়ই ভাষার ছিলো সৌন্দর্য, শক্তি এবং প্রেরণা জাগানো ক্ষমতা। “জয় বাংলা,” “তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা”—এসব শ্লোগান শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং জাতীয় চেতনার অংশে পরিণত হয়েছিলো। অথচ বর্তমান সময়ের অনেক শ্লোগান হয়ে উঠছে বিদ্বেষপূর্ণ, কুরুচিপূর্ণ এবং অর্থহীন। যে ভাষা সাধারণ মানুষকে জাগ্রত করার বদলে লজ্জায় ফেলে, সেটি কি আদৌ আন্দোলনের হাতিয়ার হতে পারে?
আজকের অনেক তরুণ-কিশোর রাজপথে আসে প্রতিবাদ করার জন্য নয়, বরং আনন্দ-উল্লাস বা কৌতূহল মেটানোর জন্য। রাজনৈতিক নেতাদের উসকানি কিংবা সামান্য অর্থের বিনিময়ে তারা মিছিলে যোগ দেয়। তাই তাদের কণ্ঠ থেকে যে ভাষা বের হয়, তাতে শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ বা নৈতিকতার ছাপ থাকে না। থাকে কেবল অশ্রাব্যতা, কুরুচি এবং হিংসার বিষ।
সমাজ-পরিবারের ভাঙন
তরুণ প্রজন্মের এই দিকভ্রান্তির পেছনে পরিবার ও সমাজের দায় কম নয়। পরিবারের নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষামূলক ভূমিকা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে। বাবা-মা ব্যস্ত নিজেদের জীবিকার টানে, সন্তানদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় সময় কাটাতে পারছেন না। ফলে তরুণরা সহজেই পড়ে যাচ্ছে অপসংস্কৃতি, ভোগবাদী মনোভাব এবং হীন রাজনৈতিক খেলায়।
যে বয়সে শিক্ষাঙ্গনে বসে পড়াশোনা, চিন্তা-চর্চা আর সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকার কথা, সেই বয়সেই অনেক তরুণকে দেখা যাচ্ছে রাজপথে চিৎকার করতে। এক সময়ের মেধাবী শিক্ষার্থী হয়ে যাচ্ছে চাঁদাবাজ, মাদকাসক্ত কিংবা ভাড়াটে বাহিনী। ফলে তাদের জীবন যেমন ধ্বংস হচ্ছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশও।
তমার প্রতীকী রূপ
এই প্রজন্মের বখে যাওয়া চিত্রকে এক কথায় প্রকাশ করা যায় “তমা” নাম দিয়ে। তমা শুধু একজন ব্যক্তি নয়, বরং একটি প্রজন্মের প্রতীক। যারা দেশ গড়ার পরিবর্তে দেশ ধ্বংসের পথে হাঁটছে। যারা আদর্শ হারিয়েছে, যারা নৈতিকতা বিসর্জন দিয়েছে, যারা প্রতিবাদকে বানিয়েছে কৌতুকের বস্তু।
যখন শোনা যায় তমার মতো কেউ চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছে, তখন তা আর আশ্চর্যের কিছু থাকে না। কারণ যে জীবনশৃঙ্খলার বাইরে, যে নৈতিকতার বাইরে, যে দায়িত্ববোধের বাইরে গিয়ে বড় হচ্ছে, তার কাছে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস বা দখলবাজি—এসবই হয়ে দাঁড়ায় ‘রাজনৈতিক অধিকার’। কিন্তু এই অধিকার কোনো প্রকৃত আন্দোলনকারীর নয়; এটি ভণ্ডামির অধিকার, ধ্বংসের অধিকার।
রাজনৈতিক স্বার্থের খেলা
সবচেয়ে করুণ সত্য হলো—এই ধরনের তরুণদের সৃষ্টি করেছে মূলত রাজনৈতিক স্বার্থবাদী গোষ্ঠী। ক্ষমতার রাজনীতিতে ভোগবাদী নেতাদের জন্য দরকার একটি অনুগত বাহিনী। সেই বাহিনী তৈরি হয় বখে যাওয়া তরুণদের দিয়ে। যাদের না আছে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা, না আছে শিক্ষার প্রতি অনুরাগ, না আছে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা। তাদেরকে সামনে ঠেলে দেওয়া হয়, উসকানি দেওয়া হয়, কখনো টাকা-পয়সা, কখনো সুবিধা, কখনো কেবল উত্তেজনার খোরাক।
ফলে তমারা রাজপথে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দেয়, সংসদে দাঁড়িয়ে গান গায়, টকশোতে বসে হিংসা ছড়ায়। অথচ প্রকৃত যোগ্য, সৎ এবং শিক্ষিত তরুণরা রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। এভাবে রাজনীতির নেতৃত্ব একসময় চলে যায় অযোগ্যদের হাতে, যারা দেশকে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়।
জাতির কপালের দোষ
তমাদের দোষ যতটা, তার চেয়ে বেশি দোষ আপামর জনতার কপালের। কারণ এই সমাজই তাদের তৈরি করেছে, তাদের জন্যই জায়গা করে দিয়েছে। আমরা প্রতিবাদ করি না, প্রতিরোধ করি না, কেবল মাথা নিচু করে মেনে নিই। রাজনৈতিক নেতারা যখন কদর্য শ্লোগান দেয়, যখন তরুণদের ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে—তখন আমরা করতালি দিই, উল্টো প্রশ্রয় দিই।
এই প্রশ্রয় না থাকলে তমাদের রাজপথে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দেওয়ার সুযোগ হতো না। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস আর উগ্রতার জায়গা হতো না।
করণীয়
১. পরিবারের দায়িত্ব: সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা, সঠিক দিকনির্দেশনা এবং সময় দেওয়া এখন সবচেয়ে জরুরি। পরিবার যদি সচেতন না হয়, তাহলে তরুণদের অন্ধকার থেকে ফেরানো অসম্ভব।
২. শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার: শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করে প্রকৃত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে যদি শিক্ষার চেয়ে বেশি রাজনীতি হয়, তবে তমাদের সংখ্যা কেবল বাড়বে।
৩. প্রতিবাদের ভাষার পরিবর্তন: আন্দোলন-সংস্কৃতিকে শৃঙ্খলিত করতে হবে। প্রতিবাদ মানে কখনো অশ্লীলতা নয়, বরং শক্তিশালী যুক্তি, সুন্দর ভাষা এবং সত্য প্রকাশ।
৪. রাজনৈতিক নেতৃত্বের জবাবদিহি: যারা তরুণদের ব্যবহার করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করছে, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনীতিকে পরিশুদ্ধ না করলে তরুণ প্রজন্মকে ফেরানো সম্ভব নয়।
৫. সচেতন সমাজ গঠন: সাধারণ মানুষকে প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, সচেতনতায় এগিয়ে আসতে হবে। প্রশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে হবে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
উপসংহার
আজকের তমারা একদিনে তৈরি হয়নি। সমাজ, পরিবার, রাজনীতি—সবাই মিলে তাদের সৃষ্টি করেছে। এখন যদি এই দিকভ্রান্ত প্রজন্মকে সঠিক পথে না ফেরানো যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য অপেক্ষা করছে আরও অন্ধকার।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম আমাদের শিখিয়েছে— সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো যায়, সুন্দর ভাষায়, আদর্শের মশাল হাতে রেখেই। তাই এখন প্রয়োজন প্রতিবাদের ভাষা বদলানো, আন্দোলনের চরিত্র বদলানো এবং তরুণদের নতুন করে জাগিয়ে তোলা।
নইলে তমারা রাজপথে শ্লোগান দিয়ে যাবে, সংসদে দাঁড়িয়ে গান গাইবে, চাঁদাবাজি করবে, সন্ত্রাস করবে। আর আমরা কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলব, ভাবব—আমাদের প্রজন্ম কোথায় গেল? কোন চুলোয় নেমে গেল?
লেখক: শফিউল বারী রাসেল (কবি, গীতিকার, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক বিশ্লেষক)
আপনার মতামত লিখুন