কেন্দুয়া থেকে তিন নারীকে চীনে পাচারের চেষ্টা; চীনা নাগরিকসহ দুইজন আটক

বিয়ের ফাঁদে ফেলে তিন নারীকে চীনে পাচারের চেষ্টাকালে নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় চীনা নাগরিকসহ দুইজনকে আটক করেছে প্রশাসন। রবিবার দিবাগত রাতে কেন্দুয়া পৌর সদরের সলফ কমলপুর গ্রামের রুবেল মিয়ার বাড়িতে থেকে তাদেরকে আটক করা হয়। বর্তমানে তাদেরকে কেন্দুয়া থানা হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
ঘটনাস্থলে সরেজমিনে পরিদর্শন করে জানা গেছে রবিবার দিবাগত রাত দশটার দিকে সলফ কমলপুর গ্রামের রুবেল মিয়ার বাড়িতে একটি প্রাইভেটকারে করে একজন চীনা নাগরিক অপর একজন বাংলাদেশী নাগরিকসহ স্থানীয় বাসিন্দা রুবেল মিয়ার গ্রামেন্টসকর্মী কন্যা ও তার খালাতো বোন এবং তার বান্ধবী জামালপুরের এক কিশোরী কন্যা আসে।
জানা গেছে,পরিবারের লোকজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা চীন চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়িতে আসে। এখান থেকে রাতেই ঢাকা চলে যাবে বলে পরিবারের লোকজনকে জানায়। ঢাকা গিয়ে পরে তারা কয়েকদিনের মধ্যেই চীন চলে যাবে বলেও জানায়। চীনা নাগরিকের সাথে রুবেল মিয়া কন্যার বিবাহ হয়েছে বলে জানতে পেরে পরিবার ও উপস্থিত স্থানীয়দের সন্দেহ হয়।
পরে স্থানীয় সচেতন কয়েকজন বিয়ের কাগজ পত্র চাইলে তারা মোবাইল ফোনে কিছু কাগজপত্র দেখায়। এতে আরও বেশি সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কাগজপত্রে অসংগতির প্রমাণ পাওয়ায় উপস্থিত মিডিয়াকর্মী মাঈন উদ্দিন সরকার মদন আর্মি ক্যাম্পের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট শাহরিয়ারকে ১ টা ৫৯ মিনিটে মুঠোফোনে বিষয়টি জানান এবং হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ডকুমেন্টস পাঠান।
পরে মদন আর্মি ক্যাম্পের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট শাহরিয়ার এ বিষয়ে মুঠোফোনে খবর পেয়ে কেন্দুয়া থানার অফিসার ইনচার্জকে অবহিত করেন এবং ঘটনাস্থলে গিয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেন।
মদন আর্মি ক্যাম্পের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট শাহরিয়ারের ফোন পেয়ে কেন্দুয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মিজানুর রহমান কেন্দুয়া থানার তদন্ত বিভাগের প্রধান ওসি (তদন্ত) মিহির রঞ্জন দেবকে নির্দেশ দেন এবং তদন্ত ওসি সঙ্গীয় ফোর্সসহ রাত দুইটা পনেরো মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌছেন।
কেন্দুয়া থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনজন কিশোরী ও একজন চীনা নাগরিকসহ একজন বাংলাদেশীকে সেখান দেখতে পায় । পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বাড়ির মালিক রুবেলের হেফাজতে তিন কিশোরীকে রেখে লি ওয়েইহাও নামে এক চীনা নাগরিক ও অপরজন বাংলাদেশী নাগরিক কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাটের আঃ হানিফ মিয়ার ছেলে মোঃফরিদুল ইসলাম (৩৫) কে আটক করে ভোর রাত চারটার দিকে প্রাইভেটকারসহ তাদেরকে কেন্দুয়া থানা হেফাজতে নিয়ে আসেন। অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা হেফাজতে তাদেরকে আটক রাখা হয়েছে। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশী নাগরিক মোঃ ফরিদুল ইসলাম নিজেকে গ্রামেন্টস কর্মী পরিচয় দিলেও তার মোবাইল ঘেঁটে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার অসংখ্য কিশোরী মেয়েদের ছবি,বিভিন্ন নারীর ভোটার আইডি কার্ড,পাসপোর্ট,অর্থ লেনদেনের চ্যাটিং,হোয়াটসঅ্যাপে নারী পাচার করে কোটি টাকা ইনকাম করার কথা বলে তাকে দোষারোপ করে অপর একজনের বেশ কয়েকটি অডিও ভয়েস পাওয়া গেছে। তার সাথে ডাচ বাংলা ব্যাংকের কার্ডসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের কার্ড পাওয়া গেছে।
জামালপুর থেকে আসা কিশোরীর জানায়,তারও অপর একজন চীনা নাগরিকের সাথে রবিবার সকালে বিয়ে হয়েছে। এখন সে চীনে চলে যাবে। এজন্য সে বান্ধবীর সাথে কেন্দুয়া এসেছে।
ফরিদুলের মোবাইল ফোনের একটি এভিডেভিট তথ্যে জানা গেছে আরও একজন চীনা নাগরিক -হুয়াং বিনবিন এর সাথে বাংলাদেশী মারুফা আক্তার মনি নামে এক নারীর বিয়ের ঘোষনাপত্র রয়েছে। যদিও তাদের এসব কাগজপত্রে বৈধতার প্রশ্ন থেকেই যায়।
কেননা তাদের বিয়ে সংক্রান্ত কাগজ পত্র বিশ্লেষনে দেখা যায়, ম্যারিজ রেজিস্ট্রার সার্টিফিকেটে পাপ্পু সাহা নামে একজন ম্যারিজ রেজিস্ট্রার স্বাক্ষর করেছেন। আসল ম্যারিজ সার্টিফিকেট সাধারণত বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত বিবাহ রেজিস্ট্রার/কাজী অফিস থেকে দেওয়া হয়। এখানে “বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজ” লেখা আছে, যা আসল ম্যারিজ রেজিস্টার অফিস নয়। ফরম্যাটও বাংলাদেশ সরকারের অফিসিয়াল ফরম্যাটের সাথে মেলে না। তাই মোবাইল ফোনে দেখানো তাদের কাগজ পত্র যথেষ্ট সন্দেহজনক।
এছাড়াও নোটারি পাবলিক এফিডেভিট সঠিক হলেও এর মানে হচ্ছে কেবল দুজন মানুষ শপথ করে লিখিতভাবে জানাচ্ছে যে তারা স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে। এফিডেভিট আসল ম্যারিজ সার্টিফিকেট নয়। এটি বিয়ের আইনগত প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট নয়। আসল বিয়ের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে হয় কাজী অফিসে (মুসলিম), চার্চে (খ্রিস্টান), ব্রাহ্ম সমাজে (হিন্দু ব্রাহ্ম), বা আদালতে। নোটারী পাবলিকের এভিডেভিট শতভাগ সত্য হলেও শুধু নোটারির কাগজে বিয়ে বৈধ হয় না।
যদি সত্যি করে চীনা নাগরিক কারো সাথে বিয়ে করতে হয়ে বা হয়ে থাকে, তবে সেটি বৈধ করতে হলে বাংলাদেশ সরকারের বৈধ ম্যারিজ রেজিস্ট্রার বা কাজী অফিস থেকে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
এরপর বিদেশি নাগরিকের ভিসা ও অভিবাসন প্রক্রিয়া আইনি পথে করতে হবে।
নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় চীনা নাগরিকসহ দুইজন আটকের ঘটনায় ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয়
একজন জানান, তিন কিশোরীসহ চীনা নাগরিক ও বাংলাদেশী নাগরিককে দেখে উপস্থিত স্থানীদের প্রথমেই তাদেরকে সন্দেহ হয়। বিয়ের প্রলোভনে এই দরিদ্র অসহায় মেয়েদের পাচার করকে এরা নাটকীয় কাহিনী করছে বলে তাদের ধারনা হয়। এজন্যই তারা বৈধ কাগজ পত্র চায় এবং তাদের যাচাই বাছাই শুরু করে।
এছাড়াও ঘটনাস্থলে উপস্থিত উচ্চ শিক্ষিত সচেতন একজন জানান,চীনা নাগরিক আটক হওয়ার পর সে লীনা নামে এক চীনা নারীর সাথে কথা বলে ম্যাসেজ করে প্রতি উত্তরে ওই নারী তাদের ভাষায় ম্যাসেজ করে যা গুগল টান্সলেটারে বাংলায় অর্থ হলো লি ওয়েইহাও যেন বিয়ে সংক্রান্ত বিষয় অস্বীকার করে এবং সর্বাবস্থায় চুপ থাকে। এরপর থেকে চীনা নাগরিক লি ওয়েইহাও একদম চুপ হয়ে যায়।
ভুক্তভোগী কিশোরীরা জানায়,তারা ঢাকা মালেকের বাড়ীতে গ্রামেন্টেসে চাকুরী করে সেখান থেকে আরও দুই বান্ধবী এভাবে বিয়ে করে কিছুদিন আগে চীন চলে গেছে। সেখান থেকে তাদের সাথে কথাও হয়েছে। তাই তারাও পাসফোর্ট করেছে এভাবে বিয়ে করে তারা চীন চলে যাবে।
বাংলাদেশী নাগরিক কুড়িগ্রামের মোঃফরিদুল ইসলাম জানান,সে গাজীপুর কোনাবাড়ীতে গ্রামেন্টেসে চাকুরির সুবাদে এক বায়ারের মাধ্যমে এই চীনা নাগরিকের সাথে অল্প কয়দিন ধরে পরিচয় হয়েছে। যদিও ফরিদুলের মোবাইলে একাধিক চীনা নাগরিকের সাথে কথোপকথন ও একাধিক বাঙ্গালী নারীসহ চীনা নাগরিকদের ডুয়েট ছবি রয়েছে। ফরিদুল নারী পাচারকারী চক্রের সদস্য বলেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনতা ধারণা করেছে।
ঘটনাস্থলে প্রশাসন উপস্থিত থাকাকালীন সময়ে আটককৃত চীনা নাগরিক লি ওয়েইহাও এর মোবাইল ফোনে চীনা নারী লীনা কনফারেন্সের মাধ্যমে ময়মনসিংহের এক টান্সলেটর (দোভাষী) কে প্রশাসনের এক কর্মকর্তার সাথে কথা বলিয়ে দেন। ময়মনসিংহের ওই দোভাষী জানান,কিছুদিন আগে দোভাষী হিসেবে চীনা কয়েকজনকে নিয়ে সে বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। এর বেশি সে চীনা নাগরিকদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানেনা। পরে ওই দোভাষীর মাধ্যমে আটক লি ওয়েইহাও এর পাসপোর্ট ভিসা চাইলে সে জানায় চীনা নারী লীনার সাথে কথা বলে পরে সে বিস্তারিত জানাবে।
তাৎক্ষনিক লি ওয়েইহাও কে সফটওয়্যার টান্সলেটের মাধ্যমে তার ভিসা পাসপোর্ট সম্পর্কে জানকে চাইলে,সে তার মোবাইল থেকে তার ভিসা দেখায়,তার ভিসা অনুযায়ী সে ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে এসেছে এবং ২১ সেপ্টেম্বর চলে যাবে বলে প্রতীয়মান হয়।
এ বিষয়ে কেন্দুয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মিজানুর রহমান জানান,খবর পেয়ে একজন চীনা নাগরিক ও একজন বাংলাদেশী নাগরিককে আটক করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো ইমদাদুল হক তালুকদার বলেন,ঘটনার বিষয়ে শুনতে পেরেছি। মূল রহস্য উদঘাটনের জন্য আটককৃতদের কেন্দুয়া থানা পুলিশ অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদ করছে । জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ঘটনার প্রকৃত বিষয়ে বলা যাবে।
নারী পাচারের চেষ্টাকালে আটককৃতদের বিষয়ে মদন আর্মি ক্যাম্পের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট শাহরিয়ার জানান,আমি খবর পাওয়ার সাথে সাথেই কেন্দুয়া থানার ওসিকে অবহিত করেছি এবং তিনি ইতোমধ্যে তাদেরকে আটক করেছেন। আইন অনুযায়ী কেন্দুয়া থানা পুলিশ পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
জানা গেছে,বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিকের জন্য ঘুরাফেরা করার শর্ত হলো বৈধ ভিসা ও পাসপোর্ট সঙ্গে রাখা বাধ্যতামূলক। তবে নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় আটক হওয়ার সময় চীনা নাগরিকের সাথে সে সময় তার পাসপোর্ট ভিসার কোন হার্ড কপি ছিলো না।
ক্ষেত্র বিশেষে বিদেশি নাগরিক বিভিন্ন এলাকায় প্রবেশের জন্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অনুমতি প্রয়োজন হয়। উপজেলা বা থানা শহরে প্রবেশ বা অবস্থান করলে স্থানীয় প্রশাসন বা আইন শৃংখলা বাহিনীর বিশেষ শাখাকে অবহিত করা বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও আটককৃত চীনা নাগরিক লি ওয়েইহাও এর কোনটিই করেন নি।
এ বিষয়ে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদের কাছে মুঠোফোনে জানতে চাইলে তিনি জানান,বিদেশি নাগরিক জেলা উপজেলায় প্রবেশ করতে হলে অবশ্যই আমাদের(প্রশাসনের) অনুমতি নিতে হয়। আটককৃত চীনা নাগরিক কেন্দুয়ায় প্রবেশের পূর্বে প্রশাসনের কোন অনুমতি নেয় নি বা অবহিতও করেনি। অনুমতি নেওয়ার বিষয়ে কোন তথ্য আমার জানা নেই। নারী পাচারকারী সন্দেহে নেত্রকোনার কেন্দুয়ায় আটককৃত চীনা নাগরিকের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জেনে নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
আপনার মতামত লিখুন